আদনান হত্যা ও কিশোর অপরাধ
Bangla Op-ed in Daily Samakal, 18 January 2017:
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
_________________________________________
ইমরান আজাদ
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের মতামত (‘আদনান হত্যা এবং নতুন বাস্তবতার সূচনালগ্ন’, দৈনিক প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১৭) আমার এ লেখার প্রেরণা। শাহদীন মালিক তার লেখায় বিভিন্ন দেশের ‘ক্রিমিনাল গ্যাং কালচার’ প্রসঙ্গ টেনে কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাকে নিয়মিত ঘটা একটা অপরাধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যভাবে বললে এ দেশে ক্রিমিনাল গ্যাং কালচার বিরাজ করে, নতুন কিছু নয় এবং গ্যাংগুলোর সংঘর্ষ আর বিবাদে হতাহতের খবরও পাওয়া যায়। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, দলীয় কোন্দল-সংঘর্ষ বা ছাত্র সংগঠনগুলোর টেন্ডারবাজির মতো ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ক্রিমিনাল গ্যাংগুলোর মারামারি-হানাহানিতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ না বলে অপরাধচক্র বা ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের দুই অংশ বলাই বরং বাস্তবসম্মত।’
এখানে তিনি যেসব উদাহরণ দিয়েছেন, সেগুলোর মাধ্যমে কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ডকে কিছুটা সরলীকরণ করা হয়েছে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে সরাসরি ‘অপরাধচক্র’ নামে অভিহিত করে শাহদীন মালিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সদস্য কর্তৃক যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তার পেছনে যে একটা রাজনৈতিক দিক আছে, তা সম্ভবত এড়িয়ে গেছেন। আমি বলছি না যে, ছাত্র সংগঠনগুলোর সদস্যরা যেসব অপরাধ করে, তার সবই রাজনৈতিকভাবে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাধারণত ছাত্র সংগঠনগুলোর সহিংসতা বা অপরাধের কারণ হিসেবে ‘দলীয় রাজনৈতিক’ দিকটা অন্যতম নিয়ামকরূপে কাজ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কিশোর আদনান হত্যার কোনো রাজনৈতিক দিক ছিল বলে জানা যায়নি। সে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল বলেও শোনা যায়নি। পত্রিকার ভাষ্যমতে, ১৬ বছর বয়সী আদনান উত্তরার একটি গ্যাংয়ের সদস্য ছিল এবং তাকে মূলত অন্য গ্যাংয়ের সদস্যরা বিরোধের জের ধরে গত ৬ জানুয়ারি হত্যা করে। আরও তথ্য হচ্ছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উত্তরায় গত কয়েক বছর ধরে বখাটে কিশোরদের মধ্যে ‘গ্রুপিং সংস্কৃতি’ গড়ে উঠেছে। এসব গ্রুপের কিশোর সদস্য বেশিরভাগ হচ্ছে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, পড়াশোনায় অমনোযোগী, দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে পথচারীদের ভয় দেখায়, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে ইত্যাদি। এখানে যে বিষয়টা পরিষ্কার করতে চাচ্ছি সেটা হলো, কিশোরদের মহল্লাকেন্দ্রিক গ্যাং কালচার আর ছাত্র সংগঠনগুলোর সহিংসতার ঘটনা_ দুটি একই বিষয় নয়। যখন কিশোর আদনান হত্যার ঘটনাকে ছাত্র সংগঠন কর্তৃক সংঘটিত আর দশটা অপরাধ বা সহিংসতার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন কিশোরদের গ্যাং কালচার সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশ্চাত্যের গ্যাং কালচারে সাধারণত দেখা যায়, উঠতি বয়সের উগ্র-বখাটে কিশোররা সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-মাদক সেবনসহ নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত থাকে। অর্থ-বিত্ত গড়ার চেয়ে চাকচিক্যময় আর অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করা তাদের বৈশিষ্ট্য।
লাতিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকোর গ্যাং কালচারের কাছে সরকারের অসহায়তার বর্ণনা দিয়ে কিংবা আফ্রিকার এক ডাকাত দলের ব্যাংক লুটের ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিতার দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে শাহদীন মালিক আরেকবার কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ডের সরলীকরণ করেছেন। এটা ঠিক যে, নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান মহল্লার বখাটে কিশোরদের আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক সহিংসতার কারণে হত্যার শিকার হয়েছে। কিন্তু উপরোলি্লখিত মেক্সিকো আর আফ্রিকার উদাহরণগুলোর প্রেক্ষিতে ‘কিশোরদের কোনো গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে অপরাধ করার প্রবণতা ও ঘটনা’র যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে শাহদীন মালিকের লেখায়, এতে কিশোর অপরাধের মতো ঘটনার যথাযথ বিশ্লেষণ হয়নি বলে মনে হচ্ছে। তবে শাহদীন মালিক খুব জোরালোভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন_ অপরাধ প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলা, বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূর্ত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড, বিচারহীনতার সংস্কৃৃতি_ এগুলোর কারণে অপরাধীরা সমাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং এতে প্রকাশ্যে বা গোপনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অপরাধীদের এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অন্যায় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
শাহদীন মালিক লিখেছেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ভীষণভাবে, তখন তারাই প্রথম ক্রিমিনাল গ্যাংকে আশকারা দেয় ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের ‘আয়ে’ ভাগ বসানোর জন্য।” এভাবেই অপরাধীরা ছাড় পায়; অপরাধের বিচার হয় না। দৃঢ়ভাবে চর্চা হতে থাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর মানুষের মাঝে প্রকট হয়ে দেখা দেয় আস্থার সংকট।
তাত্তি্বকভাবে কিশোর অপরাধের বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব। আমরা এখন যে ক্রিমিনাল গ্যাং কালচারের কথা বলছি বা শুনছি, তা মূলত বিশ্বায়ন বা অতি-আধুনিকতার অন্যতম ফল। বিশ্বায়নের সব সুযোগ-সুবিধা সাদরে নিরঙ্কুুুশ আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে দিন দিন আমরা হয়ে উঠছি ভোগবাদী মানবকুল। অনেক ক্ষেত্রে ভোগবাদের নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে দেখা দিচ্ছে মানুষে-মানুষে সহিংসতা আর বিরোধের ঘটনা। বাংলাদেশে এখনকার ক্রিমিনাল গ্যাং কালচার মূলত সে ধরনের একটি উদাহরণ। গ্যাং কালচার বেড়ে ওঠার সঙ্গে নগরায়নেরও একটা সম্পর্ক আছে, যার প্রভাব গ্রামেও দেখা যায়। শহরে হয়তো চটকদার ‘ডিস্কো বয়েজ’, ‘নাইন স্টার’ নাম নিয়ে বখে যাওয়া কিশোররা সহিংসতা করে বেড়ায়। কিন্তু গ্রামেও উত্তরপাড়া আর দক্ষিণপাড়ার মধ্যে লাঠিসোটা বা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। নগরায়ন আর বিশ্বায়নের প্রভাব দেরি করে হলেও শহর থেকে গ্রামে পেঁৗছাচ্ছে। সময়ে সময়ে, স্থানভেদে অপরাধের ধরন পাল্টায় বটে; কিন্তু অপরাধের ফলাফল সব সমাজে সাধারণত একই থাকে_ মানুষের ক্ষতি। গণমাধ্যমে যেভাবে গ্যাং কালচারের প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে, এতে জনমনে নিহত কিশোর আদনান সম্পর্কে এক ধরনের বিরূপ ধারণা জন্ম নিচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে গ্যাং কালচারে জড়িত আদনান বা অন্য বখাটেরা যে ‘কিশোর’, তা ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন মোতাবেক তারা সবাই ১৮ বছর বয়সের নিচে হওয়ায় আইনের দৃষ্টিতে ‘শিশু’ও বটে। তারা যেসব সহিংসতা করেছে বা করছে, এগুলো হচ্ছে কিশোর অপরাধ এবং আদনান মূলত কিশোর অপরাধের নির্মম শিকার। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ নতুন কোনো ঘটনা নয় এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোরদের মধ্যে সহিংসতা এই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে মতিঝিল এজিবি কলোনিতে এক কিশোর এক তরুণীকে ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিয়ে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। সে ঘটনা অনেকের মনে থাকার কথা। কিশোর আদনান হত্যাকাণ্ড পুরনো বাস্তবতার এক পুনরাবৃত্তি। আমরা আশা করি, কিশোর আদনান হত্যার বিচার হবে। আইন অনুযায়ী দোষী ব্যক্তি বিচারের মুখোমুখি হবে। কিন্তু গণমাধ্যমের অতিরঞ্জনের কারণে বিচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কিশোর অপরাধীদের প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে মানবিক দৃষ্টি প্রসারিত করার একটা বিষয় আছে, সেটা হয়তো অবহেলিত থেকে যাবে। আশঙ্কা নিয়ে শাহদীন মালিক লিখেছেন, “উত্তরায় একটা ‘ক্রসফায়ার’ হলে অবাক হবো না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলবে, আদনানের খুনি বলে তদন্তে চিহ্নিত ব্যক্তিকে ধরতে গেলে সে গুলি ছোড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টা গুলিতে সে নিহত হয়।” শাহদীন মালিকের মতো আমরাও অবাক হবো না, যখন দেখব যে নিহত আদনানের পরিবার-স্বজন ও সহপাঠীরা তার হত্যার জন্য দোষী ব্যক্তির (এমনকি সে যদি কিশোরও হয়, পত্রিকার তথ্যমতে খুনিও সম্ভবত একজন কিশোর) সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তুলবে। কিন্তু স্মরণে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক আইনসহ আমাদের দেশীয় আইনে একজন কিশোর অপরাধীকে অন্য সব অপরাধীর তুলনায় বিশেষ ও সহায়তামূলক আচরণ প্রদান করার জন্য বলা হয়েছে। যেমন, কিশোর অপরাধীকে প্রচলিত ফৌজদারি আদালতের পরিবর্তে বিশেষ কিশোর আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা, শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া, কিশোরের ঘুণে ধরা মানসিক জগতে পরিবর্তন আনয়নে পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এগুলো মেনে কিশোর অপরাধীদের বিচারের নিশ্চয়তা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কিশোর অপরাধীদের সমাজের বোঝা মনে না করে, আমাদের সবার সন্তান ভাবতে হবে। সন্তানের মঙ্গল আমাদের সবার কাম্য। আর যেন কোনো আদনান, কোনো কিশোর গ্যাং কালচারের বলি না হয় এই কামনা!
প্রভাষক, আইন ও বিচার বিভাগ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক